ঢাকা | বঙ্গাব্দ

রাষ্ট্রের দলিলে কাজী নজরুলকে জাতীয় কবির স্বীকৃতি

কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে জানলেও তার কোনো দালিলিক স্বীকৃতি এতদিন ছিল না।
  • নিজস্ব প্রতিবেদক | ০২ জানুয়ারি, ২০২৫
রাষ্ট্রের দলিলে কাজী নজরুলকে জাতীয় কবির স্বীকৃতি ছবি : সংগৃহীত।

বাংলাদেশের মানুষ কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে জানলেও তার কোনো দালিলিক স্বীকৃতি এতদিন ছিল না। অবশেষে সেই স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার।


গত ২৪ ডিসেম্বর ওই গেজেট প্রকাশ হলেও বৃহস্পতিবার তা হাতে পাওয়ার কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক লতিফুল ইসলাম শিবলী।


কাজী নজরুল ইসলামের নাতনি খিলখিল কাজী গণমাধ্যমকে বলেন, এটা ভীষণ আনন্দের সংবাদ; খুব ভালো লাগছে। এই দাবিটি তো আমাদের অনেক দিনের। এটি বাস্তবায়ন হওয়ায় ভালো লাগছে। কাজটি বাস্তবায়নে যারা কাজ করেছেন, সবার প্রতি আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই।


কাজী নজরুলকে ‘জাতীয় কবি’ স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে গত ৫ ডিসেম্বর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় অধ্যাপক ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। তবে এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন থাকায় সেটি নিষ্পত্তি সাপেক্ষে গেজেট প্রকাশ করা হবে বলে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল।


লতিফুল ইসলাম শিবলী বলেন, আদালতের বিষয়টি নিষ্পত্তি করেই গেজেট প্রকাশ হয়েছে। আমি নজরুল ইন্সটিটিউটের দায়িত্ব নেওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করেছি।


কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশনা চেয়ে ২০২২ সালের ২২ জুন আসাদ উদ্দিনসহ সুপ্রিম কোর্টের ১০ আইনজীবী রিট আবেদন করেন।


নজরুলকে জাতীয় কবির ঘোষণা দিয়ে গেজেট প্রকাশ করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে তখন রুল জারি করে হাই কোর্ট।


সংস্কৃতি বিষয়ক সচিব, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ও নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালককে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।


গেজেট চাওয়ার যুক্তিতে ওই রিট আবেদনের বলা হয়, কাজী নজরুল ইসলামের জাতীয় কবির মর্যাদার বিষয়টি ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত; রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও স্বীকৃত। এছাড়া বাংলাদেশের মানুষ তাকে জাতীয় কবি ঘোষণার প্রজ্ঞাপন প্রত্যাশা করে।


বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী নজরুল ছেলেবেলায় পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘দুখু মিয়া’ নামে। ১৯৭৬ সালের ২৯ অগাস্ট সালের (১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র) ঢাকায় মারা যান কবি নজরুল। রেওয়াজ অনুযায়ী বাংলা পঞ্জিকার তারিখ মেনে তার জন্মদিন ও মৃত্যুদিন পালন করে বাংলাদেশ।


শৈশবে পিতৃহারা নজরুলের প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয় গ্রামের মক্তবে। পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন। পাশাপাশি গ্রামের মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ নেন।


রাঢ় বাংলা (বর্ধমান-বীরভূম) অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক লোকনাট্য লেটো দলে যোগ দেওয়ার কিছু দিনের মধ্যে নজরুলের শিক্ষকতার সমাপ্তি ঘটে। ওই সময়ই তাৎক্ষণিক কবিতা ও গান লেখার দক্ষতার জন্য পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি।


১৯১০ সালে লেটো গানের দল ছেড়ে দিয়ে প্রথমে রানীগঞ্জ সিয়ারসোল স্কুল এবং পরে মাথরুন স্কুলে (নবীনচন্দ্র ইন্সটিটিউশন) ভর্তি হলেও আর্থিক অনটনের কারণে আবারও আসানসোলে চা-রুটির দোকানে কাজ নিতে হয় নজরুলকে। সেখানেই আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লার সঙ্গে তার পরিচয় হয়।


রফিজউল্লার আগ্রহে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে দরিরামপুর স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন নজরুল। সেখানে এক বছর ছিলেন তিনি। সেই ত্রিশালেই নজরুলের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়।


প্রবেশিকা শেষ না করেই ১৯১৭ সালের শেষ দিকে স্কুল ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন নজরুল। ১৯২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর চলে তার সেই সামরিক জীবন।


১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী'। ব্রিটিশ রাজের ভিত কেঁপে উঠেছিল তার অগ্নিগর্ভ কবিতার বজ্রনির্ঘোষে। ব্রিটিশবিরোধী লেখার জন্য বেশ কয়েকবার কারারুদ্ধ হতে হয় তাকে।


একে একে প্রকাশিত হতে থাকে তার গ্রন্থ অগ্নিবীণা, প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, ছায়ানট, বিষের বাঁশি, বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী, ব্যথার দান, ঘুমের ঘোরে, মৃত্যুক্ষুধা।


নজরুল প্রতিভার আরেকটি দিক প্রভা ছড়িয়েছে সংগীতে। শ্যামা সংগীত ও ইসলামী গজল- দুই ধারাতেই সমান দখল দেখানো নজরুলের লেখা গানের সংখ্যা চার হাজারের বেশি।


সৈনিক জীবনের সমাপ্তির পর নজরুলের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজাফফর আহমদের সঙ্গে। সে সময় তিনি সাপ্তাহিক লাঙ্গল, গণবাণী, ধূমকেতু, সওগাত ও সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত হন।


নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।


১৯২১ সালে কুমিল্লায় প্রমীলা দেবীর সঙ্গে পরিচয়ের তিন বছর পর পরিণয়। কবি পরিবারে আসেন কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ।


১৯৪২ সালে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্রমশ বাকশক্তি হারান নজরুল। স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসুস্থ কবিকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন।


বাংলা সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর বিশেষ সমাবর্তনের মাধ্যমে নজরুলকে সম্মানসূচক ‘ডিলিট' উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। ওই বছর ২১ ফেব্রুয়ারি তাকে ভূষিত করা হয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে।


সরকার কাজী নজরুলকেই বাংলাদেশের জাতীয় কবি বলে এসেছে। শিক্ষার্থীরা পাঠ্যপুস্তকে সে কথাই পড়ে এসেছে। প্রতি বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় কবির জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। কেবল দালিলিক কোনো স্বীকৃতি এতদিন ছিল না।


কেবল কবি নজরুল ইনস্টিটিউট আইনে জাতীয় কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের নাম লেখা ছিল।


১৯৭৬ সালের ২৯ অগাস্ট তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় মানবতা ও বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের। জাতীয় মর্যাদায় কবিকে সমাহিত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের উত্তর পাশে।


thebgbd.com/NA