ঐতিহ্যবাহী ইন্দোনেশিয়ান কালো টুপি ও শার্ট পরে একটি ইনস্টাগ্রাম ভিডিওতে বার্তা দিয়েছেন দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রাবোও সুবিয়ান্তো। তাতে তিনি তার দেশের জনগণকে প্রশ্ন করছেন, নির্বাচনের পর তিনি তাদের কীভাবে সাহায্য করতে পারেন। নভেম্বরে পোস্ট করা এমন একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট প্রাবোও জিজ্ঞেস করছেন, ‘কে আমার কাছ থেকে সাহায্য পায়নি? এখন আপনাদের কার কী প্রয়োজন?’
তবে ভিডিওতে ইন্দোনেশিয়ান এই নেতার শব্দগুলো উচ্চারণ করার সঙ্গে তার মুখের নড়াচড়া ও তার চোখের পলক ফেলার সঙ্গে মিল নেই। গত মাসে পুলিশ এর রহস্য উন্মোচন করে। এটি একটি প্রতারণামূলক ডিপফেক কেলেঙ্কারির অংশ-যা ২০টি প্রদেশ জুড়ে ইন্দোনেশিয়ানদের প্রতারিত করেছে। জাকার্তা থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি একথা জানিয়েছে।
যারা এই প্রতারণার ফাঁদে পড়েছে, তাদেরকে মেসেজ দিয়ে একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয় এবং রাষ্ট্রপতির এই সাহায্য পাওয়ার জন্য দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার থেকে ১ মিলিয়ন রুপিয়া (১৫-৬০ মার্কিন ডলার) ‘প্রশাসনিক ফি’ দিতে বলা হয়।
২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত ইন্দোনেশিয়ার নির্বাচনের সময় থেকে বিশেষজ্ঞরা ডিপফেকের (ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কোন ব্যক্তির মুখ, কণ্ঠ এবং শরীরকে পরিবর্তন করে অন্য কোন ব্যক্তির মত করে তৈরি করা ভিডিও) বিস্তার সম্পর্কে সতর্ক করে আসছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, অডিও, ছবি ও ভিডিওগুলো একজন পরিচিত ব্যক্তির কাছ থেকে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সাহায্যে এগুলো তৈরি করা হয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, প্রতারণাগুলো এতটাই পরিশীলিত যে, তারা অন্যদেরকেও প্রতারণার ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।
৫৬ বছর বয়সী ইন্দোনেশিয়ার একজন ব্যবসায়ী আরিয়ানী ডিপফেক ভিডিও দেখার পর প্রতারকদের দুই লাখ রুপিয়া দেন। তিনি বলেন, আমার টাকা দরকার, অথচ আমাকে টাকা পাঠাতে বলা হয়েছে। এমনকি তারা আমাকে ভিডিও কলও করেছে, যেন তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলি। মানুষের আরও সতর্ক হওয়া উচিত। পুরস্কারের প্রলোভনে সহজে প্রতারিত হবেন না।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রচারের সময় ডিপফেকগুলো প্রার্থীদের জন্য ক্ষতিকারক ও সহায়ক উভয়ই দিক থেকে ভুল তথ্য ছড়ানোর একটি প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে। কিন্তু এখন সেই প্রযুক্তি নগদ অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে অপরাধীদের হাতে চলে গেছে।
ব্যাপক প্রচার
এএফপির ফ্যাক্ট-চেকাররা প্রাবোওর ভুয়া ভিডিও ক্লিপ ছড়ানোর অ্যাকাউন্টটি খুঁজে পেয়েছেন- যেটার পেছনে রয়েছে ইন্দোনেশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট জিব্রান রাকাবুমিং রাকাসহ বিভিন্ন হাই-প্রোফাইল ব্যক্তিদের ছবি। অ্যাকাউন্টটিতে অনুরূপ আরও বেশকিছু ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে। এই ভিডিওগুলোতে অর্থ সাহায্যের ভুয়া তথ্যও প্রচার করা হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার ন্যাশনাল সাইবার ক্রাইম ইউনিটের পরিচালক হিমাওয়ান বাইয়ু আজী ফেব্রুয়ারিতে সাংবাদিকদের বলেছেন, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি এ ধরনের কেলেঙ্কারি থেকে ৬৫ মিলিয়ন রুপিয়া পকেটস্থ করেছেন।
বাইয়ু আরও বলেন, ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ ধরনের প্রতারণাকারী আরও একজন ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারের পরও প্রেসিডেন্টের ডিপফেক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কয়েক ডজন টিকটকে হ্যাশট্যাগসহ লেখা ‘প্রাবোও শেয়ারস ব্লেসিংস’। টিকটক বলেছে, এটি একটি ডিপফেক স্ক্যাম ভিডিও ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত অ্যাকাউন্টটি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্লাটফর্মটি কমিউনিটি গাইডলাইন লঙ্ঘন করে বিভ্রান্তিকর পোস্ট করে- এমন যে কোনও অ্যাকাউন্ট অপসারণ চালিয়ে যাবে তারা।
ফেসবুক পরিচালনাকারী প্ল্যাটফর্ম মেটার কাছে এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য এএফপি যোগাযোগ করলেও মেটা কর্তৃপক্ষ তাতে সাড়া দেয়নি। তবে ভুয়া তথ্য সংবলিত সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট যাচাই করতে এএফপিসহ ১০০ টিরও বেশি ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থাকে অর্থায়ন করেছে টিকটক ও মেটা।
আরও সহজলভ্য
ইন্দোনেশিয়ার ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা মাফিনডোর সহ-প্রতিষ্ঠাতা আরিবোও সাসমিটো বলেছেন, অনলাইনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণে তার দল প্রতি সপ্তাহে নতুন ডিপফেক কেলেঙ্কারি খুঁজে বের করছে। তিনি বলেন, আমরা গত বছর থেকে ডিপফেক ভিডিও দেখতে শুরু করেছি। এআই সরঞ্জামগুলো আরও সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী হয়ে উঠেছে। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ডিপফেক ব্যবহার করে প্রতারণা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। টেক বিলিয়নিয়ার ইলন মাস্ক ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ধরনের কেলেঙ্কারির লক্ষ্যবস্তু হওয়া সেলিব্রিটিদের মধ্যে রয়েছেন।
সূত্র: এএফপি