ভারতের উত্তর প্রদেশের হাথরাস জেলার সিকান্দরা রাউ এলাকায় ‘সৎসঙ্গ’ অনুষ্ঠানে পদদলিত হওয়ার ঘটনায় এখন পর্যন্ত অন্তত ১২১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এই ঘটনায় ক্রমশই বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। এমন পরিস্থিতিতে এই ঘটনা কেন্দ্র করে নানান প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মৃত্যুর এই মিছিলের কারণ হিসাবে অনেকেই দায়ী করছেন ‘সৎসঙ্গ’ আয়োজক কমিটিকে, প্রশ্ন তুলেছেন প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও। বলছেন, ‘অব্যবস্থাপনা’র জন্যই এমনটি ঘটেছে। আবারও কেউ কেউ কারণে হিসেবে গরমকে দায়ী করছেন!
মঙ্গলবার (২ জুলাই) বিকেলের এখন পর্যন্ত এই ঘটনায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন আলিগড় কমিশনার। একের পর এক মৃত্যুর ঘটনাকে ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ ছড়িয়েছে। ক্রমশ বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশ দাবি করে, সৎসঙ্গের জন্য যে প্যান্ডেল বাঁধা হয়, তা ব্যারিকেড দিয়ে ঘেরা ছিল। সেখানে পাখার ব্যবস্থা করা হয়নি। প্যান্ডেল খোলামেলা থাকলেও আর্দ্রতা এবং গরমের কারণে সবাই হাঁসফাঁস করেছেন। ফলে সৎসঙ্গ শেষ হওয়ার পরেই মানুষ হুড়মুড়িয়ে মাঠের বাইরে বেরনোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আসা-যাওয়ার জন্য যে গেট তৈরি হয়, সেটিও অত্যন্ত সংকীর্ণ ছিল। তাই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এতে অনেকে মাটিতে পড়ে যান। বাকিরা তাদের ওপর দিয়েই বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নারায়ণ সাকার ওরফে ‘ভোলে বাবা’ নামে স্বঘোষিত এক ধর্মীয় গুরুর জন্য ‘মানব মঙ্গল মিলন সদ্ভাবনা অনুষ্ঠান কমিটি’ মঙ্গলবার সকাল ১১টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত এই সৎসঙ্গের আয়োজন করে। এতে অংশগ্রহণ করেন হাজার হাজার ভক্ত। ভক্তদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন মহিলা। উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ওই সৎসঙ্গে যোগ দিতে আসেন তারা। সেখানেই ঘটে এই বিপর্যয়। অনুষ্ঠান থেকে বের হওয়ার সময় পদপিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন অনেকে। এদের বেশিরভাগই মহিলা। নিহতদের মধ্যে কয়েকজন শিশুও মারা গিয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকে। আহতদের ইটাওয়া হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্থান টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সৎসঙ্গে গিয়ে আহত এক ব্যক্তি বলেন, ‘ঘটনাস্থলে ওই ধর্মীয় প্রচারকের অনুগামীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। বেরিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। সবাই একসঙ্গে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। সেই সময়ই পদপিষ্টের ঘটনা হয়। অনেকে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। যখন বের হওয়ার চেষ্টা করি, তখন বাইরে মোটরসাইকেল দাঁড়িয়ে থাকায় আমার পথ আটকে যায়।’
আর এক প্রত্যক্ষদর্শীর কথায়, ‘হাজার হাজার মানুষের জনসমাগম হয়। তবে প্যান্ডেলের মধ্যে কিছু হয়নি। রাস্তায় যে মেইন গেট তৈরি হয়, সেখান দিয়ে বের হওয়ার সময় অনেকে রাস্তার ডান দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন, আর অনেকে বাঁ দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সেই সময়ই ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। যারা মাটিতে পড়ে যান, তাদের ওপর দিয়েই অনেকে চলে যান।’
স্থানীয়দের অনেকেই অভিযোগ করেন, সৎসঙ্গ উপলক্ষে সোমবার রাত থেকেই মুঘলাগড়ি গ্রামে অনুষ্ঠানস্থলের সামনের রাস্তা বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এরপর মঙ্গলবার দুপুরে সেই রাস্তা খুলে দেওয়া হয়। সৎসঙ্গ যখন শেষ হচ্ছে তখন ওই রাস্তায় আগে থেকেই যানজট ও ভিড় ছিল। ফলে হুড়োহুড়ি আরও বেড়ে যায় এবং ওই সময়ই পদদলিত হন অনেকে।
ওই অনুষ্ঠানে যে অতিরিক্ত ভিড় হয়েছে, তা মেনে নিয়েছেন হাথরাসের জেলাশাসক আশিস কুমার। তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগত একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠান শেষে বেশ হুড়োহুড়ির জন্য এই ঘটনা ঘটেছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আহতদের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ৫০ থেকে ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।’
জেলাশাসক আরও বলেন, ‘মহকুমা শাসক ওই অনুষ্ঠানের অনুমতি দেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হয়। তবে ঘটনাস্থলে ভিতরে যে ব্যবস্থা ছিল তা আয়োজকদের পক্ষ থেকেই করা হয়। আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
এদিকে, এই ঘটনায় গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। এই ঘটনা তদন্তে কয়েকটি কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে যোগী আদিত্যনাথ। পাশাপাশি দুর্ঘটনাস্থলে ত্রাণ কাজ ত্বরান্বিত করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। দ্রুত উদ্ধার ও ত্রাণের জন্য হাথরস জেলা ও এর আশেপাশের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ।
এডিজি আগ্রা এবং আলিগড়ের কমিশনারের নেতৃত্বে ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে বলেও মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকে জানানো হয়েছে। সেই তদন্ত কমিটির নেতৃত্বে থাকবেন আগ্রার অতিরিক্ত ডিজি।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর এই হাথরসের এক দলিত তরুণীর গণধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল হয় পুরো ভারত। সেই হাথরসেই আবার পদদলিত হওয়ার ঘটনা আলোড়ন ফেলে দিয়েছে দেশটিতে।